দৈনন্দিন
১
বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন সকাল থেকে।
সারাদিন।
বাদল দিনের হাওয়ার মত—
কখনও জোরে,
কখনও আস্তে।
ওরা এসেছিল ঠিক তখন।
বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে--ভেজা কাগজের নৌকো হয়ে।
ঠাণ্ডায় কেপে-ওঠা শরীর,ভিজে সাদা হয়ে যাওয়া ঠোট।
তবুও ওরা এসেছিল।
ইট-বের-করা,প্লাস্টার-খসা দেওয়ালের ঘরে জানলা--মাত্র একটাই।
পর্দার বদলে সিন্থেটিক শাড়ির ভাজে আব্রু রাখা কোনোমতে।বৃষ্টির দমকে ভিজে উঠেছিল পলকা আবরণ।
বড় জোরে পড়ছিল বৃষ্টি----
সারাদিন।
রান্নাঘরের বাসনে জল পড়ার শব্দ ছাপিয়ে উঠেছিল বাইরের বৃষ্টির শব্দ।
তা-ও এসেছিল ওরা।
নাছোড়বান্দা।
অবাক হয়ে দেখছিলাম--খাতা, অর্ধেক খোলা,কলম আধা-বন্ধ।সিগারেট হাতেই অর্ধেক জ্বলে যাচ্ছিল।
রান্নাঘর থেকে ঢুকে এসেছিলে তুমি। হাতে-শাড়িতে হলুদ-লঙ্কা-বাটনার ছাপ-ছোপ--- স্টোভের সস্তা কেরোসিনের ছিটে---রান্নাঘরের বেড়াছিটের জলে ভেজা-ভেজা।
শাড়ির পর্দা পেরিয়ে আসা নিলাজ জলে তো ভিজেছিল ঘরের একটাই সস্তা তক্তপোশ,ডাই-করা কাগজপত্র,লেখার দিস্তে খানিক অকেজো স্তূপ, সস্তা কাঠের পায়া নড়বড়ে টেবিল—
আর
খানিকটা আমিও।
"বন্ধ করছো না কেন,জানলাটা? ভিজে যাচ্ছে,ভিজে যাচ্ছ তো..."? বলতে বলতে এগিয়ে এলে তুমি, কপালে ঘাম-জলের সঙ্গে বিরক্তির ছাট।
অবাধ্য জলের ছিটে ছিটকে ভেজাল তোমাকেও-- গায়ে জল লাগতেই রাগ-বিরক্তি গলে জল।
তখনও ওরা বসে।
নাছোড়বান্দা অপেক্ষায়।
সেদিন,
সন্ধ্যেয় ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার।
দুপুরের পরে আবার বৃষ্টিও।
বড় জামবাটিতে সস্তার ঝাল চানাচুর দিয়ে মুড়ি মেখেছিলে,সঙ্গে লাল চা।
ওরা ছিল,
ওরা আসছিল,
পর-পর...পর-পর।
ভেঙে-চুরে-যোগ-বিয়োগে ওদের দিয়ে,ওদের নিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছিলাম পাতার পর পাতা--- জেদী,অবুঝ শব্দেরা বৃষ্টির মতো ভিড় করেছিল চোখে-হাতে-কলমে--পাতার পর পাতায়।
আর, ওদের মতই ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলে তুমি।
চোখের পাতায় বৃষ্টি,বৃষ্টি নিয়ে শরীর জুড়ে
,নানা কাজের ছুতোয়---- হারিকেন বাড়িয়ে,কমিয়ে--- তক্তপোশের ছাপা চাদরের কোনা ঝেড়ে-মুছে।
তুমি আছ, এটুকুই শুধু বোধ। আর কিছু না। কিচ্ছু না।
কাচা সর্ষের তেলের, চানাচুর-সস্তা চা-কেরোসিন-বৃষ্টি-শব্দের গন্ধে মিশে গেছো কখন,
নিশ্বাসে---
বেচে থাকার মতই সহজে মেনেছি।
সেদিন, চৈত্রমাস।
আচমকা বৃষ্টি ছিলো সকাল থেকে।মেঘের অন্ধকারও।অসময়ে।
সেদিন, ওরা ছিলো সকাল থেকে। আষ্টেপৃষ্ঠে তুমি ছিলে।
বৃষ্টি থেমেছে,অন্ধকার কেটেছে। ওরা গেছে।
তুমিও নেই আর।
কোথাও না। কোত্থাও না।