একদম আচমকাই ব্রেক কষতে হল ঋষিকে। মেয়েটা একেবারে সামনে এসে পড়েছে।
খুব জোর বাঁচিয়ে নিয়েছে ঋষি। যাক্ বাবা, গায়ে-টায়ে লাগেনি, নয়তো সক্কাল সক্কাল
অফিসের পথে ফালতু ঝামেলায় পড়তে হত, গাড়ির বাতানুকূলতায়ও
হাল্কা ঘেমে উঠেছিল, নিশ্চিন্ত লাগছে এখন। কিন্তু, এই ব্রেক কষার চক্করে
সিগনালটাও লাল হয়ে গেল। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে গেল ঋষির। অনায়াসে বেরিয়ে
যেতে পারত ও, তা না,.…নাও! এখন বসে থাকো। আর মেয়েটা প্রথমে একটু
হকচকিয়ে গেলেও এখন সামলে নিয়ে দিব্যি টুকটুক করে পার হয়ে যাচ্ছে রাস্তা। একটা
থ্যাঙ্কস পর্যন্ত দিল না। কি রে বাবা! অদ্ভুত লাগল
ঋষির, আর আরো অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে যেন-চিনি যেন-চিনি মনে
হচ্ছে বলে। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ভালো করে দেখল
ঋষি, মেয়েটার দিকে তাকাল।
সাদা-নীল প্রিন্টেড কুর্তি আর নীল জিন্স পরা মেয়েটা ওপারের ফুটপাথের বাসস্টপে
গিয়ে দাঁড়াল আর সিগনালটাও সময় বুঝে লাল থেকে সবুজ হয়ে গেল। আশেপাশের গাড়ির
প্রচণ্ড হর্ণে সচকিত ঋষি নামবে কি নামবে না বুঝতে-বুঝতে আর ভাবতে-ভাবতেই এগিয়ে
গেল বেশ খানিকটা । এদিকের ফুটপাথের পাশে
গাড়িটা পার্ক করে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে ঝটপট নেমে এল ও, চলে গেল নাকি! ভাবতে
ভাবতেই ওপাশের ফুটপাথের দিকে চোখ গেল ঋষির, অজান্তেই একটা হাল্কা হাসি
খেলে গেল ঠোঁটে.…যায়নি। দাঁড়িয়ে আছে ওপাশের বাসস্ট্যাণ্ডে, এখনও। মাথা নামিয়ে কাঁধের
ঢাউস ব্যাগে খুঁজছে কিছু একটা। ওর মাথাভর্তি লালচে কালো কোঁকড়া চুল, মাখন-রঙা গায়ের রঙের আঁচ, দাঁড়ানোর অতি পরিচিত ভঙ্গি ঋষিকে
নিশ্চিত করে তুলেছে এ সে-ই। যদিও ওর চোখ ঢাকা মস্ত এক সানগ্লাসে, তবু ঋষি জানে এই গাঢ়
বাদামি কাঁচের আড়ালে কালো ঘন চোখের পাতার ছায়ায় রয়েছে ঈষৎ বাদামি চোখের মণি আর
আশ্চর্য নরম দুটো দীঘল চোখ । এতবছর পরেও যেন তাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ঋষি। অবাক
লাগছে, ভালো লাগছে -- কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরে ভেতরে
অদ্ভুত একটা ভাঙনও টের পাচ্ছে ও। সিগনালের লাল হওয়ার অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই ওর
মনে হল সামনের মানুষটার মত সময়ও যেন এগোয়নি এতটুকু। দশ বছর আগে যখন বাস থেকে
নামত ঋষি, ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে, কখনও গেটের ভেতরে তড়িৎদার বুথের সামনে অথবা চারতলার
বারান্দায় যেমন দাঁড়িয়ে থাকত, এখনও যেন সেইভাবেই সময়কে থমকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও; যেন ঋষি সামনে গেলেই আগের
মত বলে উঠবে " আজকেও দেরি?" সত্যি সত্যিই বড় দেরি করে ফেলেছিল ঋষি, বড্ড দেরি করে ফেলেছে ।
আচ্ছা ও চিনতে পারবে তো! যদি না চিনতে পারে? যদি নিতান্ত অপরিচয়ের ভঙ্গিতে ফিরিয়ে দেয় ঋষিকে? তাহলে? অজান্তেই একবার টাইয়ে হাত
চলে গেল ঋষির,ঘন চুলে হাত বুলিয়ে নিল একবার। দশ বছরে ওর নিজের চেহারায় কতখানি
পরিবর্তন এসেছে ? মনে মনে একবার তখনকার ঋষির পাশে এখনকার নিজেকে দাঁড়
করিয়ে দ্রুত জরিপ করে নিল ও। ঢাকুরিয়ার শরিকি বাড়ির এজমালি ঘর থেকে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং
পড়তে আসত যে ছেলেটা, তার সঙ্গে বিগত দশ বছরে বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ
চাকুরে হয়ে ওঠা , আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা মিঃ বাসুর বেশ খানিকটা
পার্থক্য রয়েছে তো বটেই। ঋষির সাতসতেরো হিজিবিজি
ভাবনার মধ্যেই আবার চালু হয়ে গেল গাড়ির যাতায়াত। অসহায় চোখে একবার সামনে তাকাল
ঋষি,
নাঃ, ও এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
বাসস্টপের একটু পিছনের দিকে গিয়ে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঋষি বুঝতে পারছে ও কারো জন্য অপেক্ষা করছে। তা তো করবেই, করারই তো কথা-- এই দশ বছরে ঋষির দৈনন্দিনতায় যতখানি পরিবর্তন এসেছে , ততখানি কি তারও বেশি বদল ওরও এসেছে। কিন্তু তার স্বরূপ এবং গতিপ্রকৃতি ঋষির জানা নেই। কিছুই জানা নেই। ঋষি কিছু জানতেও চায় না আর। শুধু এটুকু জানে ঋষি, এটুকু ও দেখছে যে শ্রেয়া এখন ঋষির ঠিক মুখোমুখি ব্যস্ত রাস্তা নিয়ে অন্য কারোর জন্য অপেক্ষা করছে , শ্রেয়া এখন অন্য কেউ, অন্য কারোর। কিন্তু শুধু এটা বুঝছে না ঋষি যে, শ্রেয়া এখ্ন কলকাতায় কেন? আরে ! মনে মনে নিজেকে কষে একটা ধমক লাগাল ও ! এ কি ভাবছে ও! কলকাতায় না থাকলে ঋষি কি এভাবে দেখতে পেত ওকে? এই যে, এখন -- এখনও এই নামের নিঃশব্দ উচ্চারণ ঋষির মধ্যে আগের মতই আশিরনখ ছোট্ট ছোট্ট তড়িৎচুম্বকীয় প্রবাহ তৈরি করে দিচ্ছে, সেটাই বা সম্ভব হত কি করে! বৈদ্যুতিন এই প্রবাহস্রোতে ভাসতে ভাসতে ঋষি কিছুতেই ঠিক করতে পারছে না, ওপারে যাবে কি না! আচ্ছা…যদি যায়ও,কি বলবে গিয়ে । শ্রেয়া এতদিন -- এত বছর পরে ওকে দেখে কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, কী-ই বা বলবে! দশ বছর আগের ঘটনার জন্যে ওদের দুজনেরই বলবার-শোনবার আছে অনেক কিছু, কিন্তু সে-সব ঋষি বলবে কি করে । সেই যন্ত্রণার আঁচ আজো পর্যন্ত একইরকম বর্তমান ঋষিরই মধ্যে, শ্রেয়া নিশ্চয়ই আরো বেশি দগ্ধ হয়েছে। তার জন্যে ওর কাছ থেকে তিরস্কার, কটুকাটব্য,যা যা প্রাপ্য সে জন্য প্রস্তুত হয়েই রয়েছে ঋষি। কিন্তু, দশ বছর আগে ঘটমান পরিস্থিতির ওপরে যেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না ঋষির আজও তো তাই নেই । এর মধ্যে প্রায় বছর পাঁচেক হলো ও তো ভারতবর্ষেরই বাইরে স্থায়ীভাবে থিতু। এবারেও এই সময়ে আসা অফিসেরই প্রয়োজনে ---ভাগ্যক্রমে পুজোটা পড়েছে তার মধ্যে। তাই মিত্রা আর টুটুলকেও এনেছে সঙ্গে । কলকাতা ছাড়ার পরে ঋষির সঙ্গে সঙ্গে মিত্রারও পুজো আর কাটানো হয়নি কলকাতায়, বহুবার চেষ্টা করেও শীত ছাড়া আসতেও পারেনি ওরা এখানে--আর সে আসাও বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক বা দিন কুড়ির -- এবারে প্রায় একমাস থাকার বরাত। ফলে মিত্রা খুশি হয়েছে খুব। আর টুটুলের তো এবারই প্রথম সশরীরে কলকাতার পুজো দেখা, কাজেই ও প্রচণ্ড উত্তেজিত আর বাড়িতেও সবাই-ই খুশি। রুমালে একবার মুখটা মুছে নিল ঋষি। পুজোর এখনও একসপ্তাহ দেরি। পুজো এবারে একটু দেরিতে। আশ্বিন মাসের চড়া রোদে এভাবে বাইরে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এই দশ বছরে রোদ-বৃষ্টি-উত্তাপের প্রাকৃতিক ঝাপটা সহ্য করার ক্ষমতা ক্রমে ক্রমে কমে গেছে, জীবনধারণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় মহার্ঘ আয়োজন সকলের মত প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই বাতানুকূলতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এখন ঋষি। ‘ওফ্’, একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে এল নাক বেয়ে। আর একবার মুখের অস্বস্তিকর স্বেদবিন্দু মুছে নিল ও। শ্রেয়া প্রায় একভাবে দাঁড়িয়ে আছে , একবার এদিকে তাকাতেও তো পারে। কথাটা মনে হতে মনে মনেই একচোট হেসে নিল ঋষি। এখনও ওর মনে আশা আছে-- শ্রেয়া ওকে চিনবে, আগের মত কথা বলবে আর বিশ্বাস করবে! আগের মতই! ভাবল কি করে ঋষি!
কিন্তু সে আশা না থাকলে ঋষি এখানে এখন দাঁড়িয়েই বা আছে কেন? ও তো জানে, ওর অফিসের বোর্ডরুম প্রতিদিনের মত ওর অপেক্ষায় রয়েছে, আর দশ মিনিট পেরোলেই ওর হাতের মোবাইল সরব হয়ে উঠতে থাকবে পর পর ফোনে। অফিস থেকে যা যা ফোন আসার, সেগুলো তো আসবেই, মিত্রার ফোনও থাকবে। রোজের মত অফিস পৌঁছে ঋষি কেন ফোন করেনি, তা নিয়ে হাল্কা অনুযোগের সঙ্গে সঙ্গে রাতুলের কথাও মনে করিয়ে দেবে মিত্রা। রাতুল দশ বছর পরে ফিরেছে কলকাতায়, অথচ এই সময়ে কলকাতায় থাকা সত্ত্বেও ঋষি-মিত্রা না করেছে কোনো যোগাযোগ, না গেছে ওর সঙ্গে দেখা করতে, তবে, শুধু আজ কেন, এই দশ বছরের প্রথম বছরটুকু বাদ দিলে ঋষি কোনো চেষ্টাই করেনি পুরনো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটাতে, রাতুলের দিক থেকেও কোনো সাড়া ওরা পায়নি, নাঃ, হয়ত ঋষি পায়নি। মিত্রার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্যদের সূত্রে হয়তো হাল্কা একটা সংযোগ থাকলেও থাকতে পারে। ঋষি কোনো কিছু জানতে বা শুনতে ইচ্ছে করেনি--পুরনো গাঢ় বন্ধুত্বের যোগটা ঢিলে হয়ে এসেছে , আত্মীয়তার বৈবাহিক যোগ তো প্রায় ছিলই না প্রথম থেকে। মিত্রা-ঋষির বিয়েতে আসেনি রাতুল, ঋষি যোগাযোগ করতে পারেনি সেভাব , রাতুল নিজেও তখন ভারতের বাইরে -- না, এটা আগে জানতে পারেনি ঋষি, পরে মিত্রার কাছে শুনেছে। কোথায়, কেন এসব কিছু বলতে পারেনি মিত্রা আর ঋষিও জানার চেষ্টা বা আগ্রহ বোধ করেনি। সেই টানও কি অনুভব করেছে! বরং প্রাণপণে তো ভুলতেই চেয়েছে সব। প্রথম দিকের অস্থিরতা, রাগ, দিশেহারা চিন্তা আর প্রবলতর দুঃখে-অভিমানে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে ঋষি, নির্লিপ্ত হয়েছে , উদাসীন হয়েছে , পুরনো সব কিছুর ওপর পর্দা ফেলে ভুলে গেছে সব। কতটা যে ভুলতে পেরেছে, তা তো এখন বুঝছে আরো ভালো করে, কিন্তু চেষ্টা তো করেছিল। অবশ্য মিত্রা এতটা জানে না। আর জানে না বলেই রাতুলের সঙ্গে আত্মীয়তা-বন্ধুত্ব এই সূত্রে আরো একবার ঝালিয়ে নেওয়ার কথা দিনে অন্ততঃ দশবার মনে করাচ্ছে ঋষিকে। কিন্ত , প্রতিদিনের মতো এই নিয়ম আজো কেন ঘটবে? আজ নিয়মমত একঘেয়ে কিছু ঘটার থাকলে শ্রেয়া কি এভাবে এসে দাঁড়াত ওর সামনে! গায়ের দামী কোট-টা আর টাই খুলে ফুলস্লিভ শার্টের হাতা দুটো কনুই অব্দি গুটিয়ে নিল ঋষি। না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। এবারের সিগনালে ও-ও এগিয়ে যাবে। এত ভাবার কি আছে ? কিছুই তো না, কিচ্ছু না। এখন তো আর ঋষি পুরনো সম্পর্কের সুতোয়-পড়া গিঁট খুলে আবার নতুন বুনুনি তৈরি করবে না। সেটা সম্ভবও নয়। ঋষি তার স্ত্রী-পুত্রের প্রতি দায়িত্ববান, শ্রেয়াও এখন অন্য কোনো বন্ধনে আবদ্ধ, হতে তো পারে তা ভালোবাসারও! আজকে এভাবে শ্রেয়াকে না দেখলে নিজের এই নিঃস্ব চেহারা ঋষির নিজের কাছেও কি ধরা পড়ত! দশ বছর আগে যখন শ্রেয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল ওকে, তখন ঋষি ঠিক সময়ে দাঁড়াতে পারেনি ওর পাশে। ঠিক। কিন্তু তাতে কতটুকু দোষ ছিল ঋষির! তার জন্যে শ্রেয়া যে এভাবে একা করে দিয়ে যাবে ওকে, গভীরতম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে ঋষি।
একই পাড়ায় থাকত ওরা। ঋষিরা ছিল সেই পাড়ার পুরনো বাসিন্দা আর ওদের পৈতৃক শরিকি বাড়ির উল্টোদিকের তিন-চারটে বাড়ি পরে সেনকাকুদের দোতলা বাড়ির একতলায় বাবা-মা'র সঙ্গে ভাড়া থাকত শ্রেয়া। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পাড়ায় অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শ্রেয়াদের স্বল্পকালীন ভাড়াটে হিসেবে বসবাস মুখরোচক আলোচনার খোরাক জুগিয়েছিল এলাকার বাসিন্দাদের, বহুদিন পর্যন্ত। পাড়ার প্রায় লাগোয়া বাড়িগুলোর মধ্যে তুচ্ছ কারণে যেমন ঝগড়া ছিল, তেমনই পরচর্চার জন্যে প্রয়োজনীয় সদ্ভাবের অভাবও কখনও দেখেনি ঋষি। অবশ্য খুব বেশি এসব খেয়াল করার কথা মাথায় আসতেও পারত না। মাধ্যমিকে স্কুলে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে সায়েন্স নিয়ে পড়বার ইচ্ছে বাড়িতে জানানোয় যৌথ পরিবারে তখন ছোটখাটো ঝড় তুলেছে ঋষি। না। সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে বলে খুশির তুফান নয় তা। বাবা আর কাকাদের মিলিত আয়ে খুঁড়িয়ে চলা সংসারে বাবার দেওয়া টাকার ভাগ ছেলের ব্যয়সাপেক্ষ পড়াশোনায় কমবে কিনা তা নিয়েই চিন্তিত হয়েছিলেন তখনও জীবিত ঠাকুমা। নিজের পড়ার সিংহভাগ খরচ নিজে চালিয়ে নেওয়ার কথা বলে ঠাকুমা-বাবা-কাকাদের আশ্বস্ত করতে পেরেছিল ঋষি।
এই সময়েই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল রাতুল । তখন ও না থাকলে আজ জীবনের এই স্বচ্ছল বৃত্তে পা রাখতে পারত না ঋষি।
এক স্কুলে ,ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়লেও আর্থিক অবস্থার আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল দু জনের। রাতুলদের বিরাট পারিবারিক বহুমুখী ব্যবসা এবং সেই কারণে ওদের বাড়ির আর্থিক সম্পন্নতায় ঠিক স্বচ্ছন্দ বোধ করত না ঋষি, আবার ওদের বাড়িতেও রাতুল এলে একটু বাড়তি অস্বস্তিতেই পড়ত বাড়ির সবাই। কাজেই বাড়িতে যাতায়াত তেমন ছিল না, কিন্তু তাতে বন্ধুত্ব গাঢ় হতে কোনোই অসুবিধে হয়নি, ওদের কারো তরফেই। রাতুল ওর বেশ কিছু পরিচিত বাড়িতে ঋষির টিউশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ওর আত্মীয়েরাও ছিলেন। রবিবার মিত্রাকে অঙ্ক শেখাত ঋষি। মিত্রা রাতুলের দূরসম্পর্কের মামাতো বোন।
উচ্চমাধ্যমিকের দু'বছরে পাড়া ছেড়ে নিজের বাড়ির দিকেও ভালো করে তাকায়নি ঋষি। তার মধ্যেও কাকিমাদের সূত্রে পাড়ায় নতুন-আসা পরিবারের আর তার দেমাকী মেয়ের নানা কথা কানে আসত। পাড়ার বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে বন্ধুদের ইশারায় শ্রেয়াকে প্রথমবার ভালোভাবে দেখেছিল ঋষি, মায়ের সঙ্গে পাড়ার প্যাণ্ডেলে এসেছিল ও। পাড়ায় প্রায় কারো সঙ্গে না-মেশা মেয়ের চোখে সেদিন মুগ্ধতার আভাস দেখে নিজের সুদর্শন চেহারার ওপর কখন যেন বাড়তি মনোযোগী হয়ে উঠেছিল ঋষি, হয়ত খানিকটা নিজের অজান্তেই। পরে, ইউনিভার্সিটির আর্টসের ফ্রেশার্স ওয়েলকামে শ্রেয়াকে দেখে এগিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিল ও নিজেই। সমবেত উচ্ছ্বাস থেকে একটু দূরে বসেছিল শ্রেয়া, সেদিন, একা। আর বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গেলেও অন্যদের মত বাঁধভাঙা হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারেনি ঋষিও। ফ্রেশার্সের পরে ফেস্ট পার হয়ে পাড়া আর বাড়ির চোখ এড়িয়ে যাতায়াতের পথে আরো গাঢ় হয়েছিল সেই আলাপ। বাড়িতে না জানলেও রাতুলের কাছে নিজেদের গোপন রাখেনি ঋষি, তার একটা কারণ অবশ্যই যে অন্য বন্ধুদের থেকে অনেকখানি কাছের ছিল ও এবং কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়া নিজের মাধ্যমিক পরবর্তী পড়াশুনো রাতুলের জন্যেই করতে পেরেছিল, শ্রেয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল ঋষি ; আর একটা কারণ একই জায়গায় ওদের তিনজনেরই পড়াশুনো। ঋষি, রাতুল ইঞ্জিনিয়ারিং ,শ্রেয়া ইংরাজি।
শ্রেয়াদের বাড়িতে পাত্র দেখা শুরু হয়েছিল ও যখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্রী,তখনই। সমবয়সী ঋষি তখন ক্যাম্পাসিং এর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ওর সমস্ত দিনরাত তখন শ্রেয়াকে নিয়ে সুখী স্বচ্ছল জীবন যাপনের স্বপ্নে ভরে রয়েছে । প্ল্যান ছিল, ঋষি চাকরি পেলেই দুই বাড়িতে জানিয়ে দেবে ওরা। কিন্তু, কেউই বোঝেনি হঠাৎ করে শ্রেয়ার ছবি দেখে পাত্রপক্ষের পছন্দে শ্রেয়ার মতামত না নিয়েই সম্মতি জানিয়ে দেবেন ওর বাবা। এদিকে ঋষি ততদিনে পেয়ে গেছে ওর জীবনের প্রথম চাকরি আর ওর পোস্টিং-- বেঙ্গালুরু ।
চমকে উঠল ঋষি। হাতে রাখা সেলফোন বেজে উঠেছে যথারীতি -- অফিস। বাজুক, বেজে যাক। ঋষি এখন কিছুতেই অন্যমনা হবে না। শ্রেয়া ওর সামনে রয়েছে আর ঋষি এখনই গিয়ে ওকে জানাবে সত্যিটা। যে-কাজটা দশ বছর আগেই ওর করা উচিত ছিল।
কথা ছিল, ঋষি নিজে গিয়ে দাঁড়াবে শ্রেয়ার বাবার সামনে, দুজনে একসঙ্গে জানাবে নিজেদের কথা। তড়িৎদার বুথের সামনে অপেক্ষা করবে শ্রেয়া , ঋষির জন্যে, এমনটাই কথা হয়েছিল। কিন্তু , যাওয়া হয়নি ঋষির। বাড়ি থেকে বেরনোর সময়েই সেরিব্রাল হয়েছিল বাবার। দুজনের কারোর কাছেই সেলফোন ছিল না। কার্যত দিশেহারা ঋষিকে আশ্বস্ত করেছিল রাতুল। শ্রেয়ার কাছে নিজে গিয়ে জানিয়েছিল ঋষির অসহায়তার কথা আর ফিরেছিল একরাশ নীরবতা নিয়ে। রাতুলের কাছে শুনেছিল ঋষি, কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেছে শ্রেয়া। এর পরের একমাসের প্রবল চেষ্টায় বাবাকে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেও শ্রেয়াকে আর ফিরে পায়নি ঋষি। সত্যি বলতে, রাগ আর অভিমানও হয়েছিল অনেকখানি, ওই একমাসে শ্রেয়া একবারের জন্যও খোঁজ পর্যন্ত নিতে চায়নি! আর প্রথম কয়েকদিনের পরে রাতুলও আর যোগাযোগ করেনি ঋষির সঙ্গে। বাবা বিপন্মুক্ত হয়ে ওঠার পরে সব অভিমান ভুলে শ্রেয়ার সামনে দাঁড়াতে তৈরি হয়েছিল ঋষি। নতুন পাড়ায় ওদের নতুন বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তাই। জেনেছিল পাত্রপক্ষের, বিশেষত পাত্রের প্রবল আগ্রহে মাত্র দু'সপ্তাহের নোটিসে বিবাহিত শ্রেয়া তখন দিল্লি, এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের বাইরে উড়ে যাবে ও। সেই সময়ে আর একবার রাতুলের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে চেয়েছিল ঋষি। পারেনি। পুরনো সব নম্বর বদলে ফেলেছিল রাতুল। সব দ্বিধা ঝেড়ে ওদের বাড়িতেও গিয়েছিল, সদর দরজায় আটকানো বড় তালা ওকে একমাস আগের নীরবতাই ফিরিয়ে দিয়েছিল যেন। এর আরো একবছর পরে মিত্রার বাবার প্রস্তাবে একবারে বিয়েতে রাজি হয়ে যেন শ্রেয়ার উপরেই ব্যর্থ শোধ নিতে চেয়েছে ঋষি।
তীব্র একটা কষটে হাসি ফুটে উঠল ঋষির ঠোঁটে। কার ওপর শোধ নিয়েছে সেটা ও নিজেও জানে না। পুত্র, স্বামী,পিতা --যন্ত্রচালিতের মত এক-এক সম্পর্ক পালন করে চলেছে , পাশাপাশি অর্থ আর বিলাসিতার আবর্তে আকন্ঠ ডুবিয়ে দশ বছর ধরে ক্রমাগত শেষ করে দিতে চাইছে নিজেকে। আজ যদি ঋষি একবার না যেতে পারে শ্রেয়ার সামনে, তাহলে ..… তাহলে কি যে হবে, জানে না ও, জানতেও চায় না। শুধু জানে, কিছু কৈফিয়ৎ ওরও প্রাপ্য, আর সেটা আজই, এখনই। আবার থেমে গেছে সব গাড়ি -- বড় করে নিঃশ্বাস নিল ঋষি। এবারে এগোতে হবে। দৃপ্ত পায়ে এগোতে গিয়েও থেমে গেল ও। ওপারে শ্রেয়ার দিকের ফুটপাথ ধরে এগিয়ে আসছে যে, যার দিকে শ্রেয়া এগিয়ে যাচ্ছে দু-এক পা, তাকে দশ বছর পরে দেখেও এতটুকু চিনতে ভুল হচ্ছে না ঋষির। শ্রেয়া ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেকটা আর মাঝপথেই রাতুল এসে ধরে নিয়েছে ওর ছাতা। দুজনে এগিয়ে যাচ্ছে একটু দূরে পার্ক-করা সুদৃশ্য অভিজাত গাড়ির সামনে। আশ্বিনের ঝকঝকে রোদ দামি সানগ্লাস ভেদ করে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ঋষির চোখ।
সিগনাল আবার সবুজ হয়ে ব্যস্ত গাড়িতে ভরে দিল এতক্ষণের নিশ্চুপ রাস্তা।
ঋষি তখনও দাঁড়িয়ে।
No comments:
Post a Comment